স্টাফ রিপোর্টার : ভোটের দুই দিন আগে জাতীয় পার্টির (জাপা) আরও চারজন প্রার্থী সংসদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এই নির্বাচনকে ‘একপেশে’ ও ‘প্রহসন’ বলে দাবি করে বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহ, লক্ষ্মীপুর, রাজশাহী ও গাইবান্ধার চারজন প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। এ পর্যন্ত দলটির ১৭ জন প্রার্থী ভোট থেকে সরে দাঁড়ালেন।
জাপা ছাড়া বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। গতকাল দুপুরে ফটিকছড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে নৌকাকে সমর্থন জানিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। তরীকত ফেডারেশন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের শরিক দল।
নজিবুল বশর নৌকার সমর্থনে ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা উল্লেখ করে সাংবাদিকদের বলেন, ফটিকছড়িতে নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে মাঠে থাকলে ভোটের সমীকরণ অন্য রকম হবে। তাঁর প্রাপ্ত ভোট নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে বাধা হতে পারে। তরীকত ফেডারেশন ৪২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। শুধু ফটিকছড়ি আসন থেকে তিনি সরে দাঁড়িয়ে নৌকাকে সমর্থন দিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনী মাঠের পরিস্থিতি বৈরী দেখে নজিবুল বশর সরে দাঁড়ান। এবার আওয়ামী লীগ তাকে আসনটি ছাড়েনি। সেখানে নৌকা প্রতীকে খাদিজাতুল আনোয়ার ছাড়াও নজিবুল বশরের ভাতিজা ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমেদ মাইজভান্ডারী, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সদ্য পদত্যাগী ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবু তৈয়ব প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নজিবুল বশর তাদের নিষ্ক্রিয় করতে গত কয়েক দিনে নানাভাবে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। শেষে পরিস্থিতির আঁচ পেয়ে গতকাল নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।
গতকাল নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেওয়া জাপার চার প্রার্থী হলেন ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের মোস্তাফিজুর রহমান, লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসনের মুহাম্মদ রাকিব হোসেন, গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের আতাউর রহমান ও রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের প্রার্থী মো. শামসুদ্দিন। নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় পৃথক সংবাদ সম্মেলন করে তারা ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তের কথা জানান।
গত ৬ নভেম্বর লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে সাবেক এক ছাত্রলীগের নেতার ‘৫৭ সেকেন্ডে ৪৩টি ব্যালটে নৌকায় সিল’ মারার ঘটনা সারা দেশে আলোচিত হয়। সে নির্বাচনে জাপার প্রার্থী মুহাম্মদ রাকিব হোসেন নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। এবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়ে প্রার্থী হন। গতকাল রাকিব হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।
রাকিব হোসেন বলেন, ‘৮০ ভাগ এলাকায় আমার পোস্টার ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে। এখন আমার কর্মী, পোলিং এজেন্টদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কালোটাকার এমন ছড়াছড়ি শুরু হয়ে গেছে যে নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া ২৫ লাখ টাকা এক দিনেই খরচ করছে কোনো কোনো প্রার্থী। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি, নির্বাচনটা সুষ্ঠু হবে না।’
আর ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এই নির্বাচন একপেশে, সাজানো এবং ভাগাভাগির নির্বাচন। টাকার খেলার সহিংস নির্বাচন। প্রতিপক্ষ আমাকে মাঠে থাকতে দিচ্ছে না। প্রশাসনও কোনো সহযোগিতা করছে না। তাই বিবেকের তাড়নায় সরে দাঁড়ালাম।’
অবশ্য জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত এ ধরনের ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখছেন। তার মতে, এখন পর্যন্ত নির্বাচনের পরিবেশ ভালো আছে। তিনি গতকাল দুপুরে রংপুর শহরের সেনপাড়ায় পৈতৃক বাসভবন ‘স্কাই ভিউ’-এ নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে এ কথা বলেন।
দলীয় প্রার্থীদের একের পর এক নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে জি এম কাদের বলেন, এবার অধিকাংশ আসনে প্রার্থী দিয়েছে জাতীয় পার্টি। ’৯০-পরবর্তী ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা দলের ছিল না। এবার তা হয়েছে। ৩০-৪০ জন প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় বড় কিছু হবে না। ভোটের পর যাচাই করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ইতিমধ্যে জাপার ১১ জন প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন পেয়েও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। আর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন গতকাল পর্যন্ত ১৭ জন। সব মিলে দলটির ২৯ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জন ও প্রত্যাহার করলেন।
গতকাল পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো জাপার ১৮ জন প্রার্থী হলেন ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের মোস্তাফিজুর রহমান, লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসনের মুহাম্মদ রাকিব হোসেন, গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের আতাউর রহমান, রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের প্রার্থী মো. শামসুদ্দিন, চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সোহরাব হোসেন, চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের রবিউল ইসলাম, সিলেট-৫ আসনের প্রার্থী সাব্বির আহমদ, দিনাজপুর-২ আসনের মাহবুবুল আলম, নওগাঁ-২ আসনের মো. তোফাজ্জল হোসেন, সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের জাকির হোসেন, বরগুনা-১ আসনের মো. খলিলুর রহমান, বরিশাল-২ ও ৫ আসনের ইকবাল হোসেন, টাঙ্গাইল-৭ আসনের জহিরুল ইসলাম, গাজীপুর-১ ও ৫ আসনের এম এম নিয়াজ উদ্দিন, গাজীপুর-২ আসনের জয়নাল আবেদীন, গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) সামসুদ্দিন খান, হবিগঞ্জ-২ আসনের শংকর পাল ও সুনামগঞ্জ-১ আসনের আবদুল মান্নান তালুকদার।
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো এই প্রার্থীরা সরকারের সঙ্গে সমঝোতার ২৬ আসনের বাইরের। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভোটের মাঠে নানা ধরনের প্রতিকূলতায় পড়ে জাপার প্রার্থীদের অনেকে হতাশায় পড়েছেন। এর মধ্যে নির্বাচনী তহবিল না পাওয়া অন্যতম। প্রার্থীরা আশায় ছিলেন, তাঁরা দল ও সরকার থেকে আর্থিক সহযোগিতা পাবেন।
এবার আওয়ামী লীগ নির্বাচনী সমঝোতায় জাপাকে ২৬টি আসন ছেড়ে দেয়। এই আসনগুলোতে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকে কোনো প্রার্থী রাখেনি। যদিও এই ২৬টি আসনের কয়েকটি বাদে অধিকাংশ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। ফলে সমঝোতার আসনগুলোতেও জাপার প্রার্থীরা ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন না। উল্টো হুমকিসহ নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন অনেক প্রার্থী।