- স্বর্ণ চুরি
স্টাফ রিপোর্টার : হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টমসের সুরক্ষিত গুদামের লকার থেকে স্বর্ণ লুটের পর সেটি জানাজানি হয়ে গেলে নিজেদের রক্ষায় দেড় কোটি টাকার স্বর্ণ কিনে আবার গুদামে রাখে লুটেরা চক্র। শুধু তাই নয়, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এ কাণ্ডে আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে বরং লুটের বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে শেষ পর্যন্ত তা আর সম্ভব হয়নি। কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে এসেছে সাপ।
কাস্টমস গুদামের স্বর্ণের ভল্টে প্রবেশ করতে হলে ছয় স্তরের নিরাপত্তা ও গেটকিপিং পার হতে হয়। শুরুতে পাঞ্চ কার্ড। এরপর কলাপসিবল গেট। সেই গেটে দেহ তল্লাশি হয়। স্বর্ণ বা বুলিয়ন ভল্ট পর্যন্ত ৩টি ভল্টের দরজা রয়েছে। আর সেই ভল্টে প্রতিটি আলমারির পৃথক চাবি। এসব চাবি থাকে সিন্দুকে। আর এর দায়িত্বে থাকেন মাত্র দুজন। রাতে ভল্ট বন্ধ করার পর কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। এমতাবস্থায় ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া স্বর্ণ চুরি এককথায়- অসম্ভব।
কাস্টমসে কর্মরত লুটেরা চক্রের সদস্যরা সুরক্ষিত সেই ভল্ট থেকে দিনের পর দিন ধাপে ধাপে ৫৫ কেজি স্বর্ণ গায়েব করে দেয়। এক্ষেত্রে কাস্টমসের কতিপয় কর্মকর্তাও লুটেরা চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যমানের এ স্বর্ণ লুটের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় গা বাঁচাতে তারা এখন ধোয়া তুলসীপাতা বনে গেছেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, স্বর্ণ গায়েবকা-ের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে গোডাউনের দায়িত্ব পালন করা প্রায় দুই ডজন কাস্টমস কর্মকর্তা ও বিভিন্ন স্তরের কর্মচারী জড়িত।
এদিকে গুদাম থেকে স্বর্ণ চুরির কাণ্ডে গত ৩১ আগস্ট থেকে পরপর পাঁচদফা তদন্ত কমিটি করেও রহস্যজনক কারণে পরে বাতিল করে দেন ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার নুরুল হুদা। গতকাল বুধবার ঢাকা কাস্টম হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার কাজী ফরিদ উদ্দীনকে প্রধান করে ১২ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কাস্টমস সূত্র জানায়, গত ১৭ আগস্ট ৬টি ডিএমের (ডিক্লারেশন মেমো) জব্দ হওয়া স্বর্ণ খোয়া যাওয়ার বিষয়টি চাউর হয়। ডিএম নম্বরগুলো হলো ২০২৩০৮৫৩৬০৩, ২০২৩০৮৫৩৬০৬, ২০২৩৩০৮৫৩৬১৪, ২০২৩০৮৫৩৬১৮, ২০২৩০৮৫৩৬১৯, ২০২৩০৮৫৩৬২১।
সূত্র বলছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্বর্ণ গায়েবের বিষয়টি জানার পর স্বর্ণ বুঝিয়ে দিতে বললে গুদামের দায়িত্বরত সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম ও সাইদুল ইসলাম শাহেদ গড়িমসি করেন। তারা বিভিন্ন অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। লুটপাটের বিষয়টি বিমানবন্দরে কর্মরত অন্যান্য সংস্থার মধ্যেও জানাজানি হলে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের পরামর্শ ও নির্দেশে লুটপাটকারী চক্রটি রাজধানীর বায়তুল মোকাররম স্বর্ণের মার্কেট থেকে দেড় কোটি টাকা দিয়ে ১৫০ ভরি স্বর্ণ কিনে ভল্টে ঢুকিয়ে রাখেন।
কিন্তু এরপর পাওয়া যায় আরও বিস্ময়কর তথ্য; কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আাসে সাপ- জানাজানি হওয়া শুধু ওই ছয়টি ডিএম থেকেই নয়, আরও অসংখ্য চালান থেকে স্বর্ণ গায়েব করা হয়েছে। চালানগুলোর শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করে দেখা যায় শুধু ১৫০ ভরি নয়, ৫৫ কেজি স্বর্ণ গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। গায়েবকৃত স্বর্ণের পরিমাণ দেখে আর কোনো কাস্টমস কর্মকর্তা দায়িত্ব নেননি বিষয়টির সুরাহা করার। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশকে জানানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং এর পরই তা প্রকাশ্যে আসে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বর্ণ লুটের হোতা হিসেবে দুই কাস্টমস কর্মকর্তাসহ তিনজনকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। তারা হলেন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম, সাইদুল ইসলাম শাহেদ ও সিপাই নিয়ামত হাওলাদার। বিমানবন্দর থানায় মামলার প্রেক্ষিতে গত রোববার তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে যায় থানা পুলিশ। তাদের দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে। সোর্স ও প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বর্ণ লুট ও বেচাকেনার সঙ্গে এ তিনজনের সংশ্লিষ্টতার প্রাথমিক প্রমাণ পান তদন্ত কর্মকর্তারা। তবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে আসা কাস্টমস কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার দেখায়নি পুলিশ ঘটনার চার দিন পেরিয়ে গেলেও।
কাস্টমস সূত্র বলছে, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম ও সাইদুল ইসলাম শাহেদ শীর্ষ এক কর্মকর্তার আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। তাদের দাপটে তটস্থ থাকতেন কাস্টমসের অনেক কর্মকর্তা। শীর্ষ কর্মকর্তার আস্কারা পেয়েই তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের সহযোগীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সিপাহি নিয়ামত হাওলাদার।
ডিবির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আকরাম হোসেন বলেন, ‘স্বর্ণ চুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে থানা পুলিশ যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, আমরা তাদের নিয়ে এসেছি। জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তাদের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তবে এ পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।’
ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনারের এক আদেশে বলা হয়, ঢাকা কাস্টমস হাউসের আওতাধীন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিজিআর ও টিজিআর-এ সকল রক্ষিত স্বর্ণ, স্বর্ণালংকার ও বৈদেশিক মুদ্রা ইনভেন্ট্রি এবং সাম্প্রতিক প্রায় ৫৫.৫১ কেজি স্বর্ণ-স্বর্ণালংকার ঘাটতি থাকার বিষয় তদন্ত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির কাজের পরিধিতে বলা হয়েছে, সংরক্ষিত মালামাল জিআর রেজিস্টার ও ডিএমকৃত মালামালের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আছে কিনা তা ইনভেন্ট্রি করতে হবে।
ঘাটতির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে তদন্ত পরিচালনা, দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। সেই সঙ্গে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২০২০ সাল থেকে আটককৃত স্বর্ণালংকার ও বৈদেশিক মুদ্রাসহ অন্যান্য মালামালের রি-কনসিলিয়েশন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে জমাকৃত স্বর্ণ ও মুদ্রার পরিমাণ জানতে হবে। এছাড়া গুদাম ব্যবস্থাপনা সুচারুভাবে করার জন্য কী ধরনের লজিস্টিকস প্রয়োজন তা চিহ্নিত করতে হবে।
ঢাকা কাস্টমসের সুরক্ষিত ভল্ট থেকে স্বর্ণ লুটের বিষয়টি জানাজানি হয় গত রোববার। এ ঘটনায় চার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চার সিপাহিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয় পুলিশ।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ঢাকা কাস্টম হাউসের গুদাম থেকে ৫৫ কেজি ৫০১ গ্রাম সোনা খোয়া গেছে, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৫০ কোটি টাকার বেশি। সাধারণত বিমানবন্দরে যাত্রীদের কাছ থেকে জব্দ করা সোনার বার, অলংকারসহ মূল্যবান জিনিস এই গুদামে রাখা হয়। গুদামে রক্ষিত স্বর্ণের হিসাব মেলাতে গিয়েই ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চক্রটি কাস্টম হাউস থেকে দীর্ঘদিন ধরে সুকৌশলে স্বর্ণ গায়েব করেছেন। ঘটনার সঙ্গে একটি বড় এবং শক্তিশালী চক্র জড়িত। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২০ সাল থেকে লকারের স্বর্ণ গায়েব হয়েছে। এ কাণ্ডের সঙ্গে অন্তত দুই ডজন কাস্টমস কমকর্তা ও কর্মচারী জড়িত।