হাইকোর্টে আপিল নিষ্পত্তি এ বছরই

Print Friendly, PDF & Email
  • ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ১৯ বছর

স্টাফ রিপোর্টার : আওয়ামী লীগের সমাবেশে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা নিয়ে দুটি মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হাইকোর্টে নিষ্পত্তি হতে পারে এ বছরই। আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) এবং রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ও জেল আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয় গত বছরের ৪ ডিসেম্বর।

মামলার ২২৫ সাক্ষীর মধ্যে ২২৪ জনের সাক্ষ্য হাইকোর্টে উপস্থাপন করা হয়েছে। সাক্ষ্য উপস্থাপনের পর শুরু হবে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক এবং রাষ্ট্রপক্ষের পাল্টা যুক্তি খণ্ডন। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন আশা করছেন, চলতি বছরেই হাইকোর্টে আপিল নিষ্পত্তি হবে। তিনি বলেন, ‘আর ১২ থেকে ১৫ কার্যদিবস শুনানি হলেই মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসবে।’

বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে আপিলের শুনানি চলছে। তবে দেড় মাস ধরে শুনানি বন্ধ রয়েছে। হাইকোর্ট বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সহিদুল করিম কিডনিসহ নানা জটিলতায় বর্তমানে ভারতের চেন্নাইয়ে চিকিৎসাধীন। তিনি দেশে ফিরলে শুনানি শুরু হবে।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. সাইফুর রহমান বলেন, ‘চলতি সপ্তাহে বিচারপতি সহিদুল করিমের দেশে ফেরার কথা। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি বিচারিক কাজে ফিরবেন।’

ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের কয়েকশ নেতাকর্মী। এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করা হয়। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর রায় দেন ঢাকার বিচারিক আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপি আমলের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ (কারাবন্দি একজন মারা গেছেন) আসামি আপিল করেন। রায়ে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক এমপি কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, হত্যা মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের করা ২২টি আপিল ও ১২টি জেল আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন। বিস্ফোরক মামলায় বিচারাধীন ১৭টি আপিল এবং ১২টি জেল আপিল। এ প্রসঙ্গে আসামিপক্ষের আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, আপিল শুনানির জন্য তাদের প্রস্তুতি রয়েছে। আসামিদের খালাস পাওয়ার আইনগত যুক্তি আছে।

আইনি লড়াইয়ের সুযোগ নেই তারেক রহমানের

বিচারিক আদালতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে পলাতক থাকায় আপিল করার সুযোগ পাননি তিনি। আপিল করতে হলে তাকে আইন অনুযায়ী বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘পলাতক থেকে মামলায় আইনি লড়াইয়ের সুযোগ নেই। আমাদের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে এ পর্যন্ত কোর্টে হাজির না হয়ে আইনি লড়াই করার কোনো নজির নেই।’

এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘তারেক রহমানসহ মামলার যেসব সাজাপ্রাপ্ত আসামি পলাতক, তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকার সচেষ্ট। আশা করছি, মামলাটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।’

জজ মিয়া নাটক

গ্রেনেড হামলা নিয়ে মামলা দায়ের করা থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ে তদন্ত বাধাগ্রস্ত করতে তৎপরতা চালায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। ঘটনাস্থল কোন থানার আওতায়– এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় মামলা গ্রহণে অনীহা দেখায় মতিঝিল ও রমনা থানা পুলিশ। এক পর্যায়ে মতিঝিল থানা মামলা গ্রহণ করে। পরে মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে মিথ্যা সাক্ষীর অবতারণা করে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুটি মামলার নতুন করে তদন্ত শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় সিআইডির তদন্তে জজ মিয়া নাটকের বিষয়টি উদ্ঘাটিত হয়। প্রমাণিত হয় সিডি বিক্রেতা জজ মিয়া এ মামলায় সম্পৃক্ত ছিলেন না। তাঁকে দিয়ে সাজানো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ১১ সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে দেখানো হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের বিরুদ্ধে এ কাজে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ওঠে। গ্রেনেড হামলার ঘটনাস্থলে বা পরিকল্পনার সঙ্গে না থেকেও ক্ষতির শিকার হন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রামের জজ মিয়া। পরে ২০০৮ সালে ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মামলার অধিকতর তদন্ত শেষে তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

দণ্ডিতরা কে কোথায়

দণ্ডিত মোট ৪৯ আসামির মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালম পিন্টু, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউকসহ ৩০ জন কারাগারে আছেন। নথি অনুযায়ী তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জন পলাতক। তারেক রহমান ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে আছেন। অন্যদের অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই।

পুনর্তদন্তে অনেক তথ্য

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মামলার পুনর্তদন্ত শুরু হলে বেরিয়ে আসতে থাকে অনেক তথ্য। তদন্ত শেষে সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর ২০০৮ সালের ১১ জুন দুই মামলায় অভিযোগপত্র দেন। এতে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। ২০১১ সালের ৩ জুলাই তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হয়। এ নিয়ে মামলায় মোট আসামি হয় ৫২ জন।

আসামিদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামী নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে হত্যাচেষ্টা মামলায় হুজি নেতা আবদুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। তাই গ্রেনেড হামলা মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়। দুটি মামলায় শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে ‘ডাবল’ মৃত্যুদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১। তাদের মধ্যে অধিকাংশই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতা। তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে ‘ডাবল’ যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন আদালত। আসামিদের মধ্যে ১৮ জন পলাতক বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।

রায়ে বলা হয়, এ হামলার প্রস্তুতিপর্বে হাওয়া ভবনের বৈঠকে তারেক রহমান জঙ্গিদের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। হামলার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা।