স্টাফ রিপোর্টার : নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ‘জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ’(জেএমবি) কর্তৃক দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ১৮ বছর পার হলো। ২০০৫ সালের আজকের এই দিনে সারাদেশে একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়েছিল (জেএমবি)। ৬৩ জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ঢাকার ৩৪টি স্থানসহ সাড়ে ৪০০ স্পটে প্রায় ৫০০ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। এই হামলায় নিহত হন দুজন। আর আহত হন দুই শতাধিক মানুষ।
অবশ্য ২০০১ সালের আগেই বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ মদদে বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদিতার উত্থান হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনাকে হত্যার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের ভয়ংকর নজির। ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলায় নিহত মানুষের স্বজনদের আর্তনাদ ও আহত মানুষের কান্নায় দেশে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ ও ঘৃণা আরো তীব্র হয়ে উঠেছিল।
১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সারা দেশে বোমা ও গ্রেনেড হামলায় বহু মানুষ নিহত হয়েছেন। তবে ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট এ ধরনের তত্পরতা বন্ধে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। হামলা প্রতিরোধ ও জঙ্গি দমনে তৎকালীন সরকারের নিষ্ক্রিয়তা জঙ্গিবাদকে আরও শক্তিশালী এবং সক্রিয় হতে সাহায্য করেছিল।
২০০৪ সালে মতিউর রহমান নিজামী বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোন জঙ্গি নেই। বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি। পরবর্তিতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জেএমবিকে নিষিদ্ধ করে। বিএনপি-জামায়াতের মদদে সংগঠিত হয়ে ওঠা জেএমবি সারা দেশে তাদের অস্তিত্ব জানান দিতেই এই সিরিজ বোমা হামলা চালায়। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেস ক্লাব ও সরকারি-আধাসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা লক্ষ্য করে সেদিন হামলা চালান হয়েছিল।
পুলিশ সদরদপ্তর ও র্যাবের তথ্যে দেখা যায়, সিরিজ বোমা হামলায় সারা দেশের বিভিন্ন থানায় ১৫৯টি মামলা হয়। সারা দেশে দায়ের হওয়া ১৫৯টি মামলার মধ্যে রয়েছে ডিএমপিতে ১৮টি, সিএমপিতে ৮টি, আরএমপিতে ৪টি, কেএমপিতে ৩টি, বিএমপিতে ১২টি, এসএমপিতে ১০টি, ঢাকা রেঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১১টি, রাজশাহী রেঞ্জে ৭টি, খুলনা রেঞ্জে ২৩টি, বরিশাল রেঞ্জে ৭টি, সিলেট রেঞ্জে ১৬টি, রংপুর রেঞ্জে ৮টি, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ৬টি ও রেলওয়ে রেঞ্জে ৩টি। ওই ঘটনায় ঢাকা ও খুলনা রেঞ্জে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়- ২৩টি করে।
এখন পর্যন্ত ১৪২টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। বাকি ১৭টি মামলায় ঘটনার সত্যতা থাকলেও আসামি শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়। এসব মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ছিল ১৩০০ জন। গ্রেপ্তার করা হয় ৯৬১ জনকে। এক হাজার ৭২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট গ্রেপ্তার করে ৪৫৫ জনকে। আর র্যাব গ্রেপ্তার করে ৬৭ জনকে। আর পলাতক আছে ৫০ জন আসামি।
পুলিশ জানায়, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারাদেশে ১৫৯টি মামলার মধ্যে ১০২টি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এসব মামলায় ৩৩৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। ১৫ জনের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেয়া হয়। এর মধ্যে ৬ জনের ফাঁসি ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।
তারা হলেন- শায়খ আবদুর রহমান, তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই, সামরিক কমান্ডার আতাউর রহমান সানি, চিন্তাবিদ আব্দুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও সালাউদ্দিন।
এছাড়া সিরিজ বোমা হামলা মামলাগুলো থেকে ৩৪৯ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আসামিদের মধ্যে এসব মামলায় খালাস পেয়েছে ৩৫৮ জন, জামিনে রয়েছে ১৩৩ জন আসামি। এছাড়া ঢাকায় ৫টিসহ মোট ৪১টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলায় আসামি ৩৮৬ জন।
বিএনপি-জামায়াতের শাসনামল ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে সরকারি এমপি-মন্ত্রীদের মদদে সারাদেশে জঙ্গিরা শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে বলে অভিযোগ আছে। তারা ২০০৫ সালের পরবর্তী সময়ে দেশে ধারাবাহিক বোমা হামলা চালিয়ে বিচারক ও আইনজীবীসহ ৩০ জনকে হত্যা করে। ওই ঘটনায় আহত হন ৪ শতাধিক। ওই বছরের ৩ অক্টোবরে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও লক্ষীপুরের আদালতে জঙ্গিরা বোমা হামলা চালায়। এতে তিনজন নিহত ও বিচারকসহ ৫০ জন আহত হন।
সিরিজ বোমা হামলার আসামিরা ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুললেও তাদের অনুসারী ও মদদদাতারা এখনো সক্রিয়। ২০১৬ সালের হলি আর্টিজানের হত্যাযজ্ঞ তার অন্যতম দৃষ্টান্ত। যদিও এই হামলার পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে জঙ্গী দমনে তৎপরতা চালাচ্ছে এবং যেকোন স্থানে জঙ্গী নেটওয়ার্কের সন্ধান পেলেই তারা সেখানে অভিযান চালাচ্ছে এবং কঠোরভাবে সেটি দমন করছে। তবে দেশের জঙ্গিবাদের শীর্ষ নেতা ও ধর্মীয় উগ্রবাদিতার পৃষ্ঠপোষকরা পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে আছে। এদের সবাইকে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার সম্পন্ন ও রায় কার্যকর করা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জঙ্গিবাদের করালগ্রাস থেকে মুক্ত থাকতে সক্ষম হবে।