স্বীকৃতি নয়, তবে আফগানিস্তানকে জঙ্গি-ভূমি না করতে তালেবানকেই ভরসা করছে রাষ্ট্রসংঘ

Print Friendly, PDF & Email

নিউজ ডেস্ক : আফগানিস্তানের মাটিতে যাতে সন্ত্রাসবাদের বাড়বাড়ন্ত না হয় এবং লস্কর-ই-তইবা, জইশ-ই-মহম্মদের মতো সংগঠনের বিরুদ্ধে লড়াই যাতে অব্যাহত থাকে, তার জন্য তালেবানের উপরেই ভরসা রাখল রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ।খবর-আনন্দবাজার

গতকাল গভীর রাতে নিউ ইয়র্কে ভারতের সভাপতিত্বে আফগানিস্তান নিয়ে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাশ হয়েছে। তা দেখিয়ে বিদেশ মন্ত্রক আজ দাবি করেছে, ওই প্রস্তাবে ভারতের উদ্বেগের ক্ষেত্রগুলিতে নজর রাখা হয়েছে। বিদেশসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার যুক্তি, ওই প্রস্তাবে স্পষ্ট বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের মাটি কোনও দেশে সন্ত্রাসবাদী হামলা বা তার পরিকল্পনা, আর্থিক মদত বা সন্ত্রাসবাদীদের প্রশিক্ষণের জন্য কাজে লাগানো যাবে না। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রসঙ্গে লস্কর-ই-তইবা, জইশ-ই-মহম্মদের মতো নিষিদ্ধ সংগঠনের উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে তালেবানের প্রতিশ্রুতির কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদ।

প্রশ্ন উঠেছে, এই প্রস্তাবের মাধ্যমে তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথেও কি আন্তর্জাতিক মহল এক কদম এগিয়ে গেল? আফগানিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসবাদ রুখতে তালেবানের প্রতিশ্রুতির কথা করিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জ কি প্রকারান্তরে মেনে নিল যে তালেবানই এখন সে দেশের হর্তাকর্তা বিধাতা? তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে রাষ্ট্রপুঞ্জে আমেরিকার দূত লিন্ডা টমাস-গ্রিনফিল্ডের জবাব, “আমরা এখনও তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়ার জায়গায় যাইনি। ওরা এখনও সরকার তৈরি করেনি। ওরা কী ধরনের সরকার তৈরি করে, তা দেখতে হবে।” তাঁর বক্তব্য, তালেবানের সরকারে যাতে মহিলা-সহ সকলের প্রতিনিধিত্ব থাকে, আফগান সংখ্যালঘুদের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়, তার উপরে জোর দেওয়া হবে।

তালেবান যে নিরাপত্তা পরিষদের কথা মেনে চলবে, তার নিশ্চয়তা কী? কূটনৈতিক সূত্রের জবাব, তালেবানেরও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, আর্থিক সাহায্য প্রয়োজন। তার বিনিময়েই আন্তর্জাতিক মহল তালেবানের উপরে চাপ তৈরি করতে পারে। তালেবানের প্রথম জমানায় আফগানিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানি লস্কর, জইশের শিবির গজিয়ে উঠেছিল। এ বারও তার পুনরাবৃত্তি হবে বলে ভারতের আশঙ্কা। ভারতের সভাপতিত্বে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে বিষয়টির উল্লেখ থাকা ‘গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োচিত’ বলে বিদেশসচিবের দাবি।

কাতারে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত দীপক মিত্তল আজ দোহায় তালেবানের দফতরের প্রধান শের মহম্মদ আব্বাস স্তানিকজ়াইয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, ওই বৈঠকে আফগানিস্তানের মাটি যাতে ভারত-বিরোধী কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসবাদে ব্যবহার না হয়, তা নিয়ে মিত্তল উদ্বেগ জানান। তালিবান নেতা ‘আশ্বাস’ দিয়েছেন, ইতিবাচক ভাবে তাঁরা বিষয়টি বিবেচনা করবেন।

আমেরিকার সেনার শেষ বাহিনী গত রাতে যখন কাবুল ছাড়ছে, তখনই নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জে আফগানিস্তান নিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। কিন্তু ওই প্রস্তাব রাষ্ট্রপুঞ্জের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যেই ফাটল ধরিয়েছে। আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেনের তৈরি প্রস্তাবের খসড়ায় চিন, রাশিয়া সায় দেয়নি। ভোটদানে বিরত থেকেছে তারা। রাষ্ট্রপুঞ্জে চিনের প্রতিনিধি সরাসরি আমেরিকার দিকে আঙুল তুলে বলেছেন, আফগানিস্তানের পরিস্থিতির জন্য বিশৃঙ্খল ভাবে সেনা প্রত্যাহারই দায়ী। সংশ্লিষ্ট দেশের উচিত অন্যের উপরে নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে দেওয়ার অভ্যাস বদলানো।

কূটনৈতিক সূত্রের খবর, প্রস্তাবের খসড়ায় তালেবান সম্পর্কে কড়া মনোভাব নেওয়ার চেষ্টা হলেও পরে তা লঘু করতে হয়। ফ্রান্স, ব্রিটেন কাবুল বিমানবন্দরকে ‘সেফ জ়োন’ তৈরির দাবি তোলার পক্ষে ছিল। কিন্তু তা হয়নি। শুধু মাত্র তালেবানের কাছে ‘আশা’ প্রকাশ করা হয়েছে, আফগান ও অন্য দেশের নাগরিকেরা আফগানিস্তান ছাড়তে চাইলে তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি যেন রক্ষা করা হয়। চিন, রাশিয়া আরও লঘু অবস্থান নেওয়ার পক্ষে ছিল। চিনের মত ছিল, এখন আফগানিস্তান নিয়ে প্রস্তাব নেওয়ারই দরকার নেই। ভারতের বিদেশসচিবের যদিও দাবি, “এই প্রস্তাব গ্রহণ করে নিরাপত্তা পরিষদ ও আন্তর্জাতিক মহল আফগানিস্তান সম্পর্কে তাদের প্রত্যাশা নিয়ে কড়া বার্তা দিয়েছে।” ওই প্রস্তাবে কাবুল বিমানবন্দরে হামলারও নিন্দা করা হয়েছে।

বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, ভারত নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে এই প্রস্তাব নিয়ে দৌত্য করছিল। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে আমেরিকার বিদেশসচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের ফোনেও এ বিষয়ে কথা হয়। আগস্ট নিরাপত্তা পরিষদ তিন বার আফগানিস্তান নিয়ে বিবৃতি দিলেও ভারতের মত ছিল, এ বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা দরকার। দর কষাকষি করে প্রস্তাবে মানবাধিকার, মানবিক সাহায্যের কথা রাখা হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদ এ বিষয়ে ‘সজাগ থাকার’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজই নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের অস্থায়ী সভাপতিত্ব শেষ হচ্ছে। বিদেশসচিব বলেছেন, “আমরা খুশি, আফগানিস্তানের প্রতিবেশী হিসেবে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারলাম।”