নিউজ ডেস্ক : ছুটি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক একেবারে নতুন কিছু নয়। মরহুম মওলানা ভাসানী দলের ভেতরে তাঁর অনুসারীদের নেতৃত্বের ঠেলাঠেলিতে বিরক্ত হয়ে কখনো কখনো অসুস্থতাজনিত ছুটিতে যেতেন। নেতাদের মধ্যে মিলমিশ যখনই হয়ে গেল, তাঁরও অসুস্থতাজনিত ছুটি শেষ হতো। চলতি দশকে বহুল আলোচিত রাজনৈতিক অসুস্থতার কেন্দ্রে ছিলেন সাবেক সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাঁকে অসুস্থ বলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। হাসপাতালে থেকে তিনি যেমন গলফ খেলেছেন, তেমনি ভোট না করেও সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন।
তবে রাজনীতিক নন অথচ সাংবিধানিক পদের অধিকারী কারও ছুটি নিয়ে এতটা রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক বা আলোচনা আগে কখনো শোনা যায়নি। এই ছুটি আমাদের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার। তাঁর অসুস্থতাজনিত ছুটির প্রথম ঘোষণাটি এসেছে সরকারের দুটি দপ্তর থেকে—অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রীর কাছ থেকে। খবরটিতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। দীর্ঘ অবকাশের পর আদালত খোলার দিনটি থেকেই তাঁর ছুটিতে যাওয়ার সরকারি ঘোষণা নিয়ে তাই আলোচনা যেন থামছেই না। তাঁর ছুটিতে যাওয়ার প্রথম দিনেই বিস্ময় প্রকাশকারীদের উদ্দেশে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রশ্ন রেখেছেন, ‘তিনি কি অসুস্থ হতে পারেন না?’ সত্যিই তো, প্রধান বিচারপতির মতো সাংবিধানিক দায়িত্ব তো আর ব্যক্তি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার অসুস্থ হওয়া ঠেকিয়ে রাখতে পারে না!
প্রধান বিচারপতির অসুস্থতা কিংবা ছুটি নেওয়ার বিষয় এর আগে কখনো লোকমুখে আলোচিত হয়েছে বলেও আমাদের স্মরণে আসে না। আসলে যেকোনো সাংবিধানিক পদধারী—রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রধান বিচারপতি কখনো ছুটি নেন কি না সেটাই আমরা জানি না, শুনি না। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে গেলেও তাঁরা সেখান থেকেই নিয়মিত দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে যান। তবে প্রধান বিচারপতি বিদেশে গেলে তাঁর অনুপস্থিতির সময়ে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি ভারপ্রাপ্ত বিচারপতির দায়িত্ব পালনের সাংবিধানিক বিধান আছে। সময়ে সময়ে আমরা সে রকম ঘোষণা সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের দপ্তর অথবা রাষ্ট্রপতির গেজেট জারির সূত্রে জেনে এসেছি। আইনমন্ত্রীও সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়াকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্বভার দেওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপতির গেজেট জারির প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করেছেন। বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিয়া দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে গত মঙ্গলবার কাজও শুরু করেছেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এই ছুটির বিষয়ে তাঁদের সন্দেহের কথা বলে চলেছেন।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসার মূল কারণটি রাজনৈতিক বলেই অনেকের সন্দেহ। এই ছুটি যে ‘স্বাভাবিক’ বিষয়, তা বোঝানোর চেষ্টায় সরকারের পক্ষ থেকে দফায় দফায় সংবাদ সম্মেলনেই বরং বিষয়টি রাজনৈতিক কি না অনেকের মনে সেই সন্দেহ তৈরি করেছে। আইনমন্ত্রী যখন রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা প্রধান বিচারপতির চিঠি সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করে দেন, তখন বিষয়টিতে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়বে ছাড়া কমবে না, সেটাই তো স্বাভাবিক। কেননা, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধান এবং রাষ্ট্রের আরেক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বিচার বিভাগের প্রধানের মধ্যকার ব্যক্তিগত চিঠির গোপনীয়তাও তো আর রইল না।
তা ছাড়া, প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়ার পটভূমিটাও তো উপেক্ষণীয় নয়। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ তথা নির্বাহী কর্তৃপক্ষের হাতে দেওয়ার বিধানসংবলিত ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং দেশের রাজনীতির অতীত ও বর্তমান নিয়ে তাঁর কিছু পর্যবেক্ষণে সরকার ও ক্ষমতাসীন জোট যে ক্ষুব্ধ হয়েছিল তা সবারই জানা। মন্ত্রী ও সাংসদেরা যে ভাষায় সংসদের বাইরে ও ভেতরে তাঁর সমালোচনা করেছেন, তা মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে তাঁর অবস্থান নিয়ে সরকারের অস্বস্তির বহিঃপ্রকাশ শুধু যে সাংসদেরাই দেখিয়েছেন তা নয়; মন্ত্রীদের কেউ কেউ তাঁকে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হবে বলেও বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা তাঁর নিন্দায় সরব হয়েছিলেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের প্রশ্নে আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির সবাই একমত হলেও ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক চাপের পুরোটাই পড়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ওপর। কারণ হিসেবে রায়ে তাঁর পর্যবেক্ষণের কিছু বিষয়কে অপ্রাসঙ্গিক ও আপত্তিকর বলে অভিযোগ করা হয়। সরকারসমর্থক আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির সব অনুষ্ঠানও বয়কটের কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন। পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনি পন্থায় প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ তো রয়েছেই। সে রকম সিদ্ধান্তের কথাও আমরা শুনেছি। অথচ ছুটির প্রসঙ্গই এখন আলোচনার কেন্দ্রে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বক্তব্য-বিবৃতিতে একধরনের রাজনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছে, সেটা যেমন অস্বীকার করা চলে না, তেমনি সেই পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলেও গণ্য করা যায় না। প্রধান বিচারপতি সিনহা নিজেই এ বছরের জাতীয় শোক দিবসের এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন যে তিনি ক্যানসারের চিকিৎসা নেওয়ার সময় আপিল বিভাগে দায়িত্ব নিতে সিঙ্গাপুর থেকে চলে এসেছিলেন, যাতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিলের শুনানি করা যায়। তাহলে কি তাঁর ক্যানসার নিরাময় হয়নি? নাকি তা আবার ফিরে এসেছে? যেদিন তাঁর ছুটির কথা প্রচারিত হয়, সেদিন দুপুর পর্যন্ত তাঁকে কিন্তু যথানিয়মে অফিস করতে দেখা গেছে। তাঁর অসুস্থতা এমন ছিল না যে তাঁকে আদালত থেকে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। নিজের বাসায় যাওয়ার পরও গত এক সপ্তাহে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি। দেশের একাধিক চিকিৎসক তাঁকে দেখতে গেছেন। তিনি সস্ত্রীক পূজা দিতে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গেছেন এবং একটি ভিসা এজেন্সিতে গেছেন। আইসিডিডিআরবিতে তিনি যে স্বাস্থ্যগত পরীক্ষার জন্য গেছেন, সে ধরনের পরীক্ষা তিনি সেখানে আগেও করিয়েছেন বলে জানা যায়। অসুস্থতার ধরন নিয়ে তাই আলোচনা থামছেই না।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টি আদালতের রেজিস্ট্রারের অফিস থেকে জানানোর কথা। আমরা জানি, বিচার বিভাগের কোনো আলাদা সচিবালয় নেই। কিন্তু খবরটি রেজিস্ট্রার জেনারেলের দপ্তর থেকে না এসে প্রথম প্রকাশ পেয়েছে অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছ থেকে। আবার আইনমন্ত্রী বলেছেন যে তিনি নিজেই অ্যাটর্নি জেনারেলকে ছুটির চিঠির কথাটি জানিয়েছিলেন। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, এগুলো কি প্রধান বিচারপতির ছুটির বিষয় নিয়ে কারও কারও উৎসাহের সাক্ষ্য বহন করে না?
উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি সংসদের কাছে নিয়ে আসার লক্ষ্যে ষোড়শ সংশোধনীর মতো আইন তৈরির উদ্যোগটি যে ঠিক ছিল না, সে কথা আমরা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক অনেক আইনবিদের মুখ থেকেই শুনেছি। তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের আগের মেয়াদের আইনমন্ত্রীও আছেন। এখন সেই রায় বাতিলে মুখ্য ভূমিকা রাখার দায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে যে এককভাবে দায়ী করার চেষ্টা হয়েছে, তা সরকারের ভাবমূর্তির জন্য কতটা সহায়ক হয়ছে সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। প্রধান বিচারপতিকে ঘিরে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো নেতা কিসের ভিত্তিতে করছেন তা পরিষ্কার নয়। যদি সরকারের কাছে সত্যিই সে রকম প্রমাণ থেকে থাকে, তাহলে তা প্রকাশ করা উচিত। যে ব্যক্তির নিয়োগ নিয়ে সরকার কয়েক বছর ধরে গর্ব করে এসেছে, তাঁর বিরুদ্ধেই এখন নানা ধরনের অপবাদ দেওয়া হলে তাতে সরকারের ভালো-মন্দ যাচাইয়ের যথার্থতার প্রশ্নও চলে আসবে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে বলেছেন যে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার অবসরে যাওয়ার কথা আগামী বছরের ১ ফেব্রুয়ারি। সুতরাং, এর আগ পর্যন্ত তিনি ছুটি থেকে ফিরে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। সরকার তাঁর অবসরের আগে অন্য কাউকে প্রধান বিচারপতির পদে নিয়োগের কোনো উদ্যোগ নেবে না। আশা করি, তাঁর এই কথাগুলো সত্য হবে। ছুটি যেন ছুটি হয়, ছুটির মানে যেন বিদায় না হয়। প্রধান বিচারপতির অমর্যাদাকর বিদায় কাম্য নয়। এ কথা তো অনস্বীকার্য যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল নিষ্পত্তি এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করায় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনীতির অঙ্গনে যখন এসব বিতর্ক চলছে, তখন কিন্তু বিশ্ববাসীর নজরের কিছুটা ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-শান্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির সবচেয়ে মূল্যবান স্বীকৃতি নোবেল পুরস্কারের দিকে। রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে আমাদেরও সেদিকে নজর ছিল। গত সপ্তাহেই ঘোষিত হয়েছে সাহিত্যে এ বছরের নোবেল বিজয়ীর নাম, একজন জাপানি বংশোদ্ভূত ইংরেজি ঔপন্যাসিক কাজুও ইশিগুরো। বাংলা সাহিত্যে কে আবার কবে নোবেল পাবেন তা কেউই বলতে পারেন না। তবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেলপ্রাপ্তির গৌরব এখনো আমাদের অনুপ্রেরণা। ছুটি নিয়ে সেই বিশ্বকবির কিন্তু অনেক রচনা আছে। ছড়াগান ‘আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি’তে তো আমরা শিশুকাল থেকেই আনন্দ খুঁজি। ১০১ বছর আগে বলাকা কাব্যগ্রন্থে তাঁরই অন্য আরেকটি কবিতায়ও ছুটির প্রসঙ্গ আছে।
Be the first to comment on "বিশ্বায়নের কাল,প্রধান বিচারপতির ছুটি"