নীতি সুদ হার বাড়িয়ে মুদ্রানীতি ঘোষণা

Print Friendly, PDF & Email

অর্থনৈতিক রিপোর্টার: অর্থ সরবরাহ ক‌মি‌য়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কর‌তে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ লক্ষ্য নি‌য়ে চল‌তি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হ‌য়ে‌ছে। এ‌তে ঋণে সুদহার ৯ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হ‌য়ে‌ছে, তবে বাড়া‌নো হ‌য়ে‌ছে নীতি সুদ হার। সামগ্রিক বিবেচনায় এবারের মুদ্রানীতিকে সতর্কমূলক বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

রোববার (১৫ জানুয়ারি) বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে নতুন এ মুদ্রানীতি ‘মনিটারি পলিসি স্টেটমেন্ট (এমপিএস)’ প্রকাশ করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এটি তার প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা।

অনুষ্ঠানে বাংলা‌দেশ ব্যাং‌কের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফরাহ মো. নাছেরের, এ কে এম সাজেদুর রহমান খান, বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস, প্রধান অর্থনী‌তি‌বিদ ড. হা‌বিবুর রহমান, নির্বাহী প‌রিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হকসহ গবেষণা বিভাগের সং‌শ্লিষ্টরা উপস্থিত ছি‌লেন।

মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর জানান, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাবাজার ও সুদহা‌রের নিয়ন্ত্রণের ল‌ক্ষ্য নি‌য়ে মুদ্রানীতি করা হ‌য়ে‌ছে। আগামী‌তে এন‌পিএল (খেলা‌পি ঋণ) কমা‌নো ও সুশাসন নি‌শ্চিত কর‌তে কাজ কর‌বে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও প্রকাশ করে। দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে এর একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হ‌য়ে‌ছে।

নতুন অর্থবছরের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। ত‌বে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু উপকরণ ব্যবহার ছাড়া তেমন কোনো করণীয় নেই। যে কয়েকটি উপকরণ রয়েছে, তার অন্যতম প্রধান হলো টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে কম হারে ঋণ দেওয়া। এজন্য চল‌তি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ প্রথমার্ধের ম‌তো একই হার ধরে দ্বিতীয়ার্ধের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক ক‌রে‌ছে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশ‌মিক ১০ শতাংশ করা হ‌য়ে‌ছে। আ‌গের অর্থবছ‌রে যা ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

তবে বাজেটের বিশাল ঘাটতির অর্থায়নে সরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমায়‌নি, বরং বা‌ড়ি‌য়ে‌ছে। দ্বিতীয়ার্ধে এ লক্ষ্য ঠিক ক‌রে‌ছে ৩৭ দশ‌মিক ৭০ শতাংশ করা হ‌য়ে‌ছে।

মূল্যস্ফীতির চাপ কমা‌তে, পাশাপা‌শি বি‌নি‌য়োগ ও কর্মসংস্থানের ল‌ক্ষ্যে ঋণ সরবারহ নি‌শ্চিত কর‌তে নী‌তি হার হিসা‌বে বি‌বে‌চিত রে‌পো সুদহার ২৫ বে‌সিস প‌য়েন্ট বা‌ড়ি‌য়ে ৫ দশ‌মিক ৭৫ থে‌কে ৬ শতাংশ করা হ‌য়ে‌ছে। অর্থাৎ এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থে‌কে ব্যাংকগু‌লো জরু‌রি প্র‌য়োজ‌নে অর্থ নি‌লে গুনতে হ‌বে অ‌তি‌রিক্ত সুদ।

পাশাপা‌শি রিভার্স রে‌পোও ২৫ বে‌সিস প‌য়েন্ট বা‌ড়ি‌য়ে ৪ শতাংশ থে‌কে ৪ দশ‌মিক ২৫ শতাংশ করা হ‌য়ে‌ছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা রাখ‌লে ব্যাংকগু‌লোকে আ‌গের চে‌য়ে বে‌শি সুদ পা‌বে। এছাড়া মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ১২ দশমিক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশে নামানো হয়েছে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতিকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে রাখার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কিন্তু সবশেষ নভেম্বর মাস শেষে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক ঋণে জোর দেবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি পূরণে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেবে বলে লক্ষ্য ঠিক করছে সরকার। এই অংক চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা আছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০২২) ব্যাংক থেকে সরকারের নিট বা প্রকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। তবে অন্যদিকে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে নতুন করে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিয়েছে ৬৫ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ শোধ করেছে ৩৩ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট বা প্রকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করেছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। আগের মুদ্রানীতিতে যা ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ ছিল। মূলত সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ বৃদ্ধির প্রবণতা বিশ্লেষণ করে মুদ্রানীতিতে প্রাক্কলন কিছুটা কমানো হয়েছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ৫ম মাস নভেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। আগের মাস অক্টোবর শেষে যা ছিল ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে এই হার ছিল ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১৪ দশমিক ০৭ শতাংশ এবং জুলাই মাসে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ।