জঙ্গিবাদে জড়িয়ে সন্তানকে ‘হিজরতে’ পাঠানো মায়ের আহাজারি!

Print Friendly, PDF & Email

স্টাফ রিপোর্টার : বেসরকারি এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানে এয়ার হোস্টেস হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে চাকরি ছাড়েন, এমনকি স্কুলপড়ুয়া সন্তানকেও ঠেলে দেন জঙ্গিবাদের পথে।

অবশেষে নিজের ভুল বুঝতে পেরে কাঁদলেন, সন্তানকে আহ্বান জানালেন ভুলপথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার। দীর্ঘ আট মাস নিরুদ্দেশ থাকা সন্তানকে ফিরে পেতে এখন আহাজারি করছেন এই মা। আম্বিয়া সুলতানা এমিলি নামের এই মাকে শনাক্ত করার পর ডি-র‌্যাডিকালাইজেশন প্রক্রিয়া শুরু করে র‌্যাব।

বুধবার (৯ নভেম্বর) কারওয়ানবাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সামনে এসে নিজের ভুল বুঝতে পারার কথা জানান তিনি।

আম্বিয়া সুলতানা এমিলি নিজের ১৫ বছরের ছেলে আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ানকে নিজ হাতে জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দেন। একসময় তার ভাষ্য ছিল, আল্লাহর পথে সন্তানকে সমর্পণ করলেন। অথচ এখন জঙ্গিবাদে জড়িয়ে বর্তমানে বান্দরবানে পাহাড়ে অবস্থান করা সন্তানকে ফিরে আসার আর্জি জানাচ্ছেন এই মা।

র‌্যাব জানায়, সম্প্রতি নিরুদ্দেশ তরুণদের বিষয়ে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা নজরদারি করতে গিয়ে তথ্য পায়, নারায়ণগঞ্জ থেকে আবু বক্কর ওরফে রিয়াসাদ রাইয়ান নামক এক তরুণ গত মার্চ মাসে নিরুদ্দেশ হয়। তার পরিবার সংশ্লিষ্ট থানায় একটি জিডি করে। ইতোপূর্বে প্রকাশিত নিরুদ্দেশ ৫৫ জনের তালিকায় আবু বক্করের নাম রয়েছে।

গত ৩ নভেম্বর অভিযানে র‌্যাব নতুন জঙ্গি সংগঠনের মহিলা শাখা সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় এবং জানতে পারে যে, একজন মা উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এরপর এই মা তার সন্তানকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতে পাঠিয়েছেন।

প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ ও নজরদারির মাধ্যমে আম্বিয়া সুলতানা ওরফে এমিলিকে গত ৫ নভেম্বর উদ্ধার করে এবং তাকে পরিবারের সান্নিধ্যে রেখে ডি-র‌্যাডিকালাইজেশনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চালায় র‌্যাব।

র‌্যাব জানায়, ছেলের শিক্ষক আল-আমিনের মাধ্যমে এমিলি ও তার ছেলে আবু বক্কর ২০২১ সালের প্রথম দিকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনে যোগ দেন। পরবর্তীতে আবু বক্কর ২০২২ সালের মার্চ মাসে আল আমিনের নির্দেশনায় প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে বাড়ি থেকে বের হয় এবং সে আর বাড়িতে ফিরে আসেনি।

আম্বিয়া সুলতানা এমিলি তার ছেলে নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ ও অবস্থান সম্বন্ধে জানলেও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছে তা গোপন করেন। অবু বক্করের পিতা থানায় তার ছেলের নিখোঁজের জিডি করাসহ ছেলের সন্ধানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হন।

আবু বক্কর পাহাড়ে প্রশিক্ষণে যাওয়ার পর তার কোনো খোঁজখবর না পেয়ে সন্তানের চিন্তায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন এবং ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করতে থাকেন আম্বিয়া সুলতানা এমিলি। পরবর্তীতে র‌্যাব সদস্যরা তার সন্ধান পেলে সন্তানকে ফিরে পেতে ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এই মা।

আম্বিয়া সুলতানা এমিলি সাংবাদিকদের বলেন, “আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করা মেয়ে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে চাকরি করেছি। ২০১৩ সালে বিমান বাংলাদেশে চাকরি করেছি খণ্ডকালীন। আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, চরম ভুল একটা পথকে সঠিক মনে করে সন্তানকে দিয়েছিলাম।

এ কারণে আজকে আমার আদরের সন্তান বান্দরবানের পাহাড়ে অর্ধমৃত অবস্থায় আছে। আমি জানি না আমার সন্তান বেঁচে আছে কিনা? জানি না আমি কখনো দেখতে পাবো কিনা? এটা মা হিসেবে আমার চরম ব্যর্থতা।

শিক্ষিত মেয়ে হয়েও আমি বুঝতে পারিনি। আমার কোরআন হাদিসের দক্ষতা কম ছিল। আমি বুঝতে পারিনি সঠিক কোনটা, ভুল কোনটা। আমাকে মোটিভেটেড করা হয়েছে। আমার সন্তান আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ানকেও মোটিভেট করে আমাকে মিসগাইড করা হয়েছে।

জঙ্গিদের গ্রুপ, সংগঠনের নাম, তাদের কর্মকাণ্ড সবকিছু আমার কাছে গোপন করা হয়েছিল। একটা ভুল বিষয়কে আমার সামনে কোরআন হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে বোঝানো হয়েছে সঠিক হিসেবে। আমার ছেলে আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ান মেধাবি ছাত্র ও বিনয়ী ছিল। বিপথে নেওয়ার জন্য আমার ছেলের মতো ছেলেদেরই টার্গেট করা হচ্ছে, যার শিকার আমি হয়েছি।”

এমিলি আরও বলেন, “র‌্যাবের যারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তারা খুবই সাবলীলভাবে দীর্ঘ সময় ধরে বুঝিয়েছেন। আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, তারা আমাকে বোঝার সুযোগ দিয়েছেন। জঙ্গিদের উদ্দেশ্য কী, দেশের জন্য তারা কতটা ভয়ঙ্কর, দেশে যে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়—এসব কিছু এখন আমার কাছে পরিষ্কার। একজন মা কখনো চায় না তার আদরের সন্তান বিপথে চলে যাক। সন্তান যতই খারাপ হোক না কেন, মা কখনো তা চায় না।”

তিনি বলেন, “আমার সন্তান চলতি বছরের ১৫ মার্চ ঘর থেকে বেরিয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে তার শিক্ষক আল আমিন দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি দেশে ফিরে যোগাযোগ করেন। আল আমিন আমাদের খুবই বিশ্বস্ত ছিল। ভদ্র বিনয়ী আল আমিন খুব ভালো পড়াতো বলে আমরা তাকে খুবই পছন্দ করতাম। সেই আমাদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেছে। সে আমাদের কোরআন হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছে। সে বলেছিল, প্রস্তুতি নিতে হবে, গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে তৈরি হয়ে থাকতে হবে।

আমিও ভুল বুঝে মেনে নিয়েছিলাম। আমাকে বলা হয়েছিল, আমার সন্তানকে প্রশিক্ষণে নিয়ে যাওয়া হবে, ভালো প্রশিক্ষণ, সে সব কিছু জানবে। সে দেখা করতে পারবে, সে যোগাযোগ করতে পারবে। সে বাসায় আসতে পারবে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাকে ভুল বোঝানো হয়েছে।”

আম্বিয়া সুলতানা এমিলি আরও বলেন, “আমি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আমি যে ভুল করেছি, আমার বুকটা যেভাবে খালি হয়েছে, সেই একই ভুল যেন কোনো বাবা-মা না করেন। আমি শিক্ষিত মেয়ে হয়েও শেষ হয়ে যাচ্ছি। এখন আমার পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ। আমার খাওয়া ঘুম সব হারাম হয়ে গেছে!

আমি সাংবাদিকদের মাধ্যমে বলতে চাই, আব্বু… যদি তুমি আমার মেসেজ পেয়ে থাকো। তুমি চরম একটা ভুল পথে আছো। তুমি তোমার মাকে বিশ্বাস করতে পারো। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি যদি কখনো তোমার মাকে ভালবেসে থাকো, তাহলে তুমি দেশের জন্য কোনো ধরনের হুমকির কাজ করবে না, কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা, নৃশংসতা, অন্যায় কাজে শামিল হবে না। আমি অনুরোধ করছি, তুমি আত্মসমর্পণ করো।”

সন্তানের উদ্দেশে মা এমিলি আরও বলেন, “তোমার বাবা অনেক অসুস্থ হয়ে গেছে। আমি খুব ভয় পেয়ে গেছি, যদি তার কিছু হয়ে যায়! তোমার বাবার জন্য চরম ব্যর্থতা হবে যদি তুমি বিশৃঙ্খলা করো, নৃশংস কিছু করো। তুমি তোমার বাবা-মাকে অপমানিত করো না। এই দেশে জন্ম নিয়ে তুমি অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছো।“

মা হিসেবে নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে এমিলি বলেন, “আমি শিক্ষিত মা হিসেবে অনুরোধ করছি, বাবা-মা হিসেবে সন্তানকে সময় দেবেন, সময় দেবেন, বুকে জড়িয়ে ধরবেন, ভেতরটা জানার চেষ্টা করবেন, ভালোবাসবেন। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, অবহেলা করবেন না। সে ছিটকে যেতে পারে যেকোনো সময়, তখন আমার মতো বুক ভাসিয়ে আর কোনো লাভ হবে না!“

প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের ছোট ছোট সন্তানেরা পাহাড়ে না খেয়ে কীভাবে আছে! ওরা তো ঘরেই ছিল, মায়ের বুকে ছিল। ওরা ওখানে কীভাবে বাঁচবে? ওরা নিজেও জানে না কোথায় তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওদের ফিরিয়ে আনুন, ওদের সুযোগ দিন, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার, মায়ের বুকে ফিরে আসার। ওদের উদ্ধার করুন।”