উখিয়ার ট্রেনিং ক্যাম্প বন্ধে ক্ষোভ, এরপর বোমা হামলা

Print Friendly, PDF & Email

স্টাফ রিপোর্টার : গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা, রমনার বটমূলে বোমা হামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি জঙ্গি নেতা আব্দুল হাইকে (৫৭) গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-২। দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর ধরে আত্মগোপনে থাকা আব্দুল হাই ছিলেন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি-বি) প্রতিষ্ঠাতা আমির।

আশির দশকে ভারত-পাকিস্তানের মাদরাসায় পড়াশোনা করা আব্দুল হাই আফগানিস্তানেও মুজাহিদ হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেন।

১৯৯১ সালে দেশে ফিরে এসে “হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বাংলাদেশ” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। যার আমীর নির্বাচিত হয় গ্রেপ্তারকৃত মুফতি আব্দুল হাই। এরপর ১৯৯২ সালের প্রথম দিকে গ্রেপ্তারকৃত আব্দুল হাই কক্সবাজারের উখিয়ার একটি মাদ্রাসায় যায় এবং সেখানে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করে। পার্শ্ববর্তী দেশের এক জঙ্গি নেতা ঐ ট্রেনিং ক্যাম্পে অস্ত্র সরবরাহ করত এবং গ্রেপ্তারকৃত মুফতি আব্দুল হাই ও তার দুই সহযোগী সেখানে প্রশিক্ষণ প্রদান করত। উক্ত স্থানে তারা ৪ বছর অবস্থান করে এবং কৌশলে তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। অতঃপর ১৯৯৬ সালে যৌথবাহিনীর অভিযানে উক্ত ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে ৪১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

র‌্যাব জানায়, উখিয়ার ট্রেনিং ক্যাম্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষিপ্ত হন জঙ্গি নেতা আব্দুল হাই। এরপর একে একে ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টা, ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বোমা হামলা, ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালে হবিগঞ্জে গ্রেনেড হামলায় জড়িত ছিলেন।

পলাতক জঙ্গি নেতাদের বিষয়ে নজরদারির ধারাবাহিকতায় অবশেষে বুধবার (২৫ মে) রাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এলাকায় অভিযান চালিয়ে দীর্ঘ ১৭ বছর পলাতব হুজি-বির প্রতিষ্ঠাতা আমির মুফতি আব্দুল হাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ৭টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে, যার মধ্যে ২টি মৃত্যুদণ্ড ও ২টি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সর্বমোট তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা ১৩টি।

বৃহস্পতিবার (২৬ মে) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, ২০০০ সালে তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায় জনসভার অদূরে জঙ্গি মুফতি আব্দুল হাইসহ তার অপরাপর জঙ্গি সদস্যগণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুতে রাখার ঘটনায় কোটালীপাড়া থানায় বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আইনে ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে ২টি মামলা রুজু হয়। তদন্ত শেষে উক্ত মামলায় বিজ্ঞ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। পরবর্তীতে দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট গ্রেপ্তারকৃত মুফতি আব্দুল হাইসহ ১০ জন মৃত্যুদণ্ড এবং ৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।

খন্দকার আল মঈন বলেন, ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে ছায়ানটের বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালীন সময় প্রকাশ্য দিবালোকে জঙ্গিদের অতর্কিত বোমা হামলায় ১০ জন মৃত্যুবরণ করেন এবং আরও অনেকে আহত হন। উক্ত ঘটনায় রমনা থানায় একটি হত্যা মামলাসহ বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা রুজু করা হয়। হত্যা মামলাটির বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৪ সালের ২৩ জুন বিজ্ঞ আদালত ০৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ০৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। অপরদিকে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে রুজুকৃত মামলাটি বিজ্ঞ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ বিচারাধীন রয়েছে।

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে একটি জনসভা চলাকালে প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলা হয়। উক্ত গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত এবং প্রায় তিন শতাধিক গুরুতর আহত হয়। বর্ণিত ঘটনায় ঢাকার মতিঝিল থানায় একটি হত্যা ও হত্যা চেষ্টার সহযোগিতাসহ ২টি পৃথক মামলা রুজু হয়। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ১০ অক্টোবর ২০১৮ সালে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং মুফতি আব্দুল হাইসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। গ্রেফতারকৃত মুফতি আব্দুল হাই উক্ত গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। অপরদিকে একই ঘটনায় ঢাকার মতিঝিল থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে একটি পৃথক মামলা রুজু হয়। গ্রেপ্তারকৃত মুফতি আব্দুল হাই বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী। এ ছাড়াও ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদরে বৈদ্যের বাজারে জঙ্গিরা গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ ৫ জনকে হত্যা করে এবং কমপক্ষে শতাধিক লোককে আহত করে। উক্ত হত্যা ও বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তারকৃত আব্দুল হাই চার্জশীটভুক্ত পলাতক আসামী এবং তার বিরুদ্ধে ২ টি গ্রেপ্তাররি পরোয়ানা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে কুমিল্লা জেলায় সর্বমোট ৭টি গ্রেপ্তাররি পরোয়ানা রয়েছে।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত আরো জানায়, সে নারায়ণগঞ্জ জেলার দেওভোগ মাদ্রাসায় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত হেফজ বিভাগে পড়ালেখা করে। এরপর ১৯৮১ সালে অবৈধভাবে পার্শ্ববর্তী দেশে গমন করে দেওবন্দ দারুল উলুম মাদ্রাসায় লেখাপড়ার জন্য ভর্তি হয়। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত দেওবন্দে পড়ালেখা করে মাস্টার্স সমতুল্য দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করে। এরপর দেওবন্দ থেকে ১৯৮৫ সালের শেষে ঐ দেশের নাগরিক হিসাবে একটি পাসপোর্ট তৈরি করে পার্শ্ববর্তী দেশের নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং ১৯৮৬ সালে পুনরায় ঐ দেশে প্রত্যাবর্তন করে। পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে পাকিস্তানি ভিসা নিয়ে ট্রেন যোগে পাকিস্তানের করাচীতে গমন করে সেখানকার একটি মাদ্রাসা থেকে ২ বছরের ইফতা কোর্স সম্পন্ন করে মুফতি টাইটেল অর্জন করে। ১৯৮৯ সালে ঐ মাদ্রাসায় একাধিক বাংলাদেশিসহ বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি মিরানশাহ বর্ডার দিয়ে আফগানিস্তানে মুজাহিদ হিসাবে গমন করে। সেখানে বাংলাদেশের কয়েকজন জঙ্গি সদস্য ও ৩০/৩৫ জন পাকিস্তানি নাগরিক একত্রিত হয়ে একটি ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি এক হুজি নেতা এবং বাংলাদেশী এক জঙ্গির নেতৃত্বে অক ৪৭ রাইফেল ও থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পরবর্তীতে আফগানিস্তানে গমন করে তাদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করে। আফগানিস্তানে থাকাকালীন ‘হুজি-বি’ সময়ে প্রতিষ্ঠা করেন।

গ্রেপ্তারকৃত মুফতি আব্দুল হাই “জাগো মুজাহিদ” মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকাটি ১৯৯১ সালে চালু হয় এবং তার অফিস খিলগাঁও থানাধীন তালতলা নামক স্থানে। পরবর্তীতে ২০০০ সালে সরকার পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করে। গ্রেপ্তারকৃত মুফতি আব্দুল হাই ২০০০ সালে উক্ত পত্রিকার অফিস হতেই গ্রেপ্তার হয় এবং ২মাস কারাভোগ শেষে জামিনে মুক্তি পায়।

গ্রেপ্তারকৃত মুফতি আব্দুল হাই ২০০০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কোটালীপাড়ার সভাস্থলে বোমাপুতে রেখে তাকে হত্যা চেষ্টা, ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা, ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা চেষ্টাসহ ২৪ জনকে হত্যা এবং তিনশতাধিক লোককে আহত করা, ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদরে বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ ৫ জন নিহত এবং কমপক্ষে শতাধিক লোক আহতের ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিল।

আলোচিত বিভিন্ন জঙ্গিবাদী ঘটনার সাথে হরকাতুল জিহাদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসলে ২০০৬ সালের পর মুফতি আব্দুল হাই আত্মগোপনে চলে যায়। তার পরিবার তখনও নারায়ণগঞ্জেই বসবাস করত কিন্তু সে কুমিল্লা জেলার গৌরিপুরে তার শ্বশুরবাড়ী এলাকায় আত্মগোপন করে। গৌরিপুর বাজারে তার শশুরের কেরোসিন ও সয়াবিন তেলের ডিলারশিপের ব্যবসা ছিল। সে সারা দিন ব্যবসা দেখাশুনা করে ঐ দোকানেই রাত কাটাত। এভাবেই ২০০৯ সাল পর্যন্ত সে তার শ্বশুর বাড়ীর এলাকা গৌরিপুরে আত্মগোপনে ছিল। গৌরিপুরে আত্মগোপনে থাকাবস্থায় সে মাঝেমধ্যে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন পূর্বক নারায়ণগঞ্জ যাতায়াত করত। পরবর্তীতে কৌশলে সে তার ও তার পরিবারের সকলের ঠিকানা পরিবর্তন করে নারায়ণগঞ্জে ভোটার হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। স্থানীয় এলাকাবাসী যেন তার পরিচয় জানতে না পারে সে জন্য ঘর থেকে খুব কম বের হত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে তার বর্তমান ঠিকানার বাসাটি এলাকার লোকজনের কাছে তার বড় ছেলের বাসা হিসেবেই পরিচিতি করায়। গত রাতে র‌্যাব-২ এর একটি অভিযানে নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানার হাজীগঞ্জ এলাকায় আসামীর বর্তমান ঠিকানা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।