নারীত্বের মর্যাদা রক্ষায় নুসরাতের আত্মত্যাগ অমরত্ব : আদালত

Print Friendly, PDF & Email

নিউজ ডেস্ক : ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার ঘটনায় গাফিলতির অভিযোগে সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেমকে তিরস্কার করেছেন আদালত। একই সঙ্গে সাংবাদিক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ দিয়েছেন বিচারক।

বৃহস্পতিবার নুসরাত হত্যা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদ।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, এ ঘটনায় তৎকালীন ওসি গাফিলতি করেছেন। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের কর্মকাণ্ড না ঘটে, সে ব্যাপারে সবাই সতর্ক হবেন। হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি মানুষের সামনে আনার জন্য সাংবাদিক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানান।

বিচারক মামুনুর রশিদ বলেন, নারীত্বের মর্যাদা রক্ষায় নুসরাত জাহান রাফির তেজোদীপ্ত আত্মত্যাগ তাকে অমরত্ব দিয়েছে। নুসরাতের অমরত্ব চিরকালের অনুপ্রেরণা। আসামিদের ঔদ্ধত্য মানবতাকে লজ্জিত করবে চিরকাল।

নুসরাত হত্যার রায়ে বিচারক বলেন, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ দেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। নূর উদ্দিন হত্যার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সার্বিক সহযোগিতা করেন। শাহাদাত হোসেন শামীম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে মুখ ও মাথা চেপে ধরে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেন। সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর মাকসুদ আলম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১০ হাজার টাকা দেন এবং হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করেন।

পাশাপাশি সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের এবং জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ নুসরাতের ওড়না দুই ভাগ করে হাত-পা পেঁচিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন দেন। মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ আব্দুল কাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার পর আসামিদের ঘটনাস্থল ত্যাগে সহযোগিতা করেন। প্রভাষক আবছার উদ্দিন মাদরাসার গেটের পাহারায় থেকে আসামিদের নিরাপদে পার করে দেন।

একই সঙ্গে সহপাঠী কামরুন নাহার মনি সাইক্লোন শেল্টারের ফ্লোরে নুসরাতকে শুইয়ে বুক চেপে ধরেন এবং শরীরে আগুন দিতে সহযোগিতা করেন। সহপাঠী উম্মে সুলতানা পপি হত্যার পরিকল্পনা অনুযায়ী নুসরাতকে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে ডেকে নেন এবং ওড়না খুলে পা ধরে শরীরে আগুন দিতে সহযোগিতা করেন।

এছাড়া আব্দুর রহিম শরীফ, ইমরান হোসেন মামুন ও ইফতেখার উদ্দিন রানা ঘটনায় সময় মাদরাসার গেটের বাইরে পাহারায় থেকে অন্যদের নিরাপদে ঘটনাস্থল ত্যাগে সহযোগিতা করেন। মোহাম্মদ শামীম, মহিউদ্দিন শাকিল ঘটনার সময় সাইক্লোন শেল্টারের নিচে পাহারার দায়িত্ব পালন করে অন্যদের সহযোগিতা করেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রুহুল আমীন হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন।

এসব বিষয় প্রমাণিত হওয়ায় ১৬ আসামির মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার আদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হলো। জরিমানার অর্থ আদায় করে ভিকটিমের বাবাকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেয়া হলো।

রায়ে বিচারক মামুনুর রশিদ বলেন, এ মামলার আলামত হিসেবে উদ্ধার হওয়া বোরকা, ওড়না, আগুনে পোড়া নুসরাতের সালোয়ারের অংশ, ওড়নার পোড়া অংশ, ম্যাচের কাঠি, মোবাইল, সিডি, জুতা, কেরোসিন মিশ্রিত পলিথিন, ড্রাম, চুঙ্গি, নুসরাতের লেখার খাতা, পরীক্ষার খাতা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হলো। একই সঙ্গে ফেনী জেলা কারাগারের দর্শনার্থীদের রেজিস্টার বইটি জেলখানায় পাঠানোর আদেশ দেয়া হলো।

চলতি বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৬ এপ্রিল ওই মাদরাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত জাহান রাফি।

এ ঘটনায় মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে প্রধান আসামি করে আটজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করে নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন।

নুসরাত হত্যা মামলায় পুলিশ ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ২১ জনকে বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করে। পরে ২৯ মে ১৬ জনকে আসামি করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে পিবিআই। সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় নূর হোসেন, আলাউদ্দিন, কেফায়েত উল্যাহ জনি, সাইদুল ও আরিফুল ইসলামের নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়া হয়।

৩০ মে মামলাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ১০ জুন আদালত মামলাটি আমলে নিলে শুনানি শুরু হয়। ২০ জুন অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। ২৭ ও ৩০ জুন মামলার বাদী মাহমুদুল হাসান নোমানকে জেরার মধ্য দিয়ে বিচারকাজ শুরু হয়। এরপর ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন।

মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের ও জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। বৃহস্পতিবার নুসরাত হত্যায় অধ্যক্ষ সিরাজসহ ১৬ জনের ফাঁসির আদেশ দেন বিচারক।