শিক্ষামন্ত্রীর অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকার কেক নিয়ে তুলকালাম

Print Friendly, PDF & Email

নিউজ ডেস্ক : বিজয় দিবস উপলক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকার আদলে তৈরি করা একটি কেক নিয়ে সোমবার তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে। অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আয়োজনের বাইরে হঠাৎ আনা এই কেক দেখে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। জাতীয় পতাকার আদলে তৈরি করা কেকটি কারা কি উদ্দেশ্যে এনেছে সেবিষয়ে খোঁজ নিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, সোমবার (১৮ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বিজয় দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্তর্গত মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ (মাউশি)। অনুষ্ঠানটি মন্ত্রণালয়ের হলেও শিক্ষামন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ঢাকার সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। নির্ধারিত অনুষ্ঠানটি শেষ হলে উপস্থিত সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে করতে চা চক্রে হাজির হন শিক্ষামন্ত্রী। এসময় তিনি ছিলেন খোশমেজাজে।ঠিক এসময় অনুষ্ঠানস্থলে হাজির করা হয় জাতীয় পতাকার আদলে তৈরি করা বিশাল আকৃতির একটি কেক। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পূর্তি উপলক্ষে কেকটি আনা হয়েছে উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রীকে কেকটি কাটার অনুরোধ করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি’র কর্মকর্তারা। কিন্তু কেকটি দেখে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হন শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ। তিনি বলেন, ‘আমাকে জাতীয় পতাকার আদলে কেক কাটতে বলছেন? আমি জাতীয় পতাকা কাটবো?’

মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নির্ধারিত কর্মসূচি শেষ করে শিক্ষামন্ত্রী হল থেকে বেরিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যান চা চক্রে যোগ দিতে। এসময় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) অতি উৎসাহী কয়েকজন কর্মকর্তা ৪৬ কেজি ওজনের একটি কেকের সামনে নিয়ে যান মন্ত্রীকে। অনুরোধ করেন জ্বালানো মোমবাতি নিভিয়ে কেকটি কাটতে। কিন্তু কেক দেখেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন মন্ত্রী। পুরো অনুষ্ঠানে অত্যন্ত হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত থাকা মন্ত্রীর হঠাৎ রুদ্রমূর্তি দেখে কর্মকর্তারা চুপসে যান। একে অন্যের ওপর দায় চাপাতে থাকেন। কেক কোথায় থেকে এলো, কে নিয়ে এলো,কার সিদ্ধান্তে জাতীয় পতাকার আদলে তৈরি করা হলো―তার দায়িত্ব নিতে রাজি হননি অনুষ্ঠান সংশ্নিষ্ট কোনও কর্মকর্তাই।

প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ মন্ত্রী এসময় বলেন, ‘কেকে কেন জাতীয় পতাকা? আমি কি জাতীয় পতাকা কাটতে এসেছি? এটা কার আইডিয়া? কে অর্ডার দিয়ে এই কেক বানিয়েছে? একজন মন্ত্রী হয়ে আমি কি জাতীয় পতাকা কাটতে পারি?’

এসময় এই কাজের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের শাস্তি পেতে হবে বলেও উল্লেখ করেন মন্ত্রী। একপর্যায়ে চা পান না করেই অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রুটিন দায়িত্বে থাকা সচিব মো. মহিউদ্দিন খান জানান, নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে প্রতিবারের মতো এবারও মন্ত্রণালয় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

তিনি বলেন, আমাদের নির্ধারিত কর্মসূচি কিংবা পরিকল্পনাতে কেক কাটার বিষয়টি ছিল না। এ নিয়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কখনও আলোচনাও করেননি।

তাহলে হঠাৎ করে কোথা থেকে এনে হাজির করা হলো এতবড় কেক? কারা নিয়ে নিয়ে এলো জানতে চাইলে মহিউদ্দিন খান বলেন,‘আমি কেকের বিষয়ে কিছুই জানতাম না। কোথা থেকে এই কেক এলো, কারা নিয়ে এলো, অতি উৎসাহী এই কর্মকর্তা কারা―তাদের খুঁজে বের করতে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার অতিরিক্ত সচিব আমিনুল ইসলামকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি বলে জানান।

এ বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত সচিব আমিনুল ইসলামের অফিসে যোগাযোগ করলে তার পিও জানান, তিনি অফিসের বাইরে রয়েছেন। পরে একাধিকবার মুঠোফোনে চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এদিকে, কেকটির উৎস সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তা জানান,মন্ত্রীকে খুশি করতে মাউশিতে দীর্ঘদিন থেকে কর্মরত এক উপ-পরিচালকের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে এই কেক তৈরি করে নিয়ে আসা হয় অনুষ্ঠানস্থলে। তার নাম কামাল উদ্দিন হায়দার। প্রচণ্ড দাপট দেখিয়ে বেড়ানো এই কর্মকর্তা মূলত মন্ত্রীকে খুশি করার উদ্দেশ্যে কেকটি বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন,কামাল উদ্দিন হায়দার ছিলেন মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভেল্যুয়েশন প্রকল্পের উপ-পরিচালক। গতকাল সোমবার তার প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তাকে ওএসডি করা হয়। তাদের ধারণা, গুরুত্বপূর্ণ কোনও পদে পোস্টিং বাগিয়ে নিতে ঐদিনই তিনি কেক দিয়ে মন্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলেন। মন্ত্রণালয়ের যে কোনও অনুষ্ঠানেও তিনি অতি উৎসাহীর মতো ব্যাপক তৎপর থাকেন।

তারা জানান,সোমবার যখন মন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয় কেক কাটতে তখন কামাল উদ্দিন হায়দারের সঙ্গে ছিলেন আরেক ক্ষমতাধর উপপরিচালক (প্রশাসন) শফিক সিদ্দিকী, উপ-পরিচালক খুরশীদ আলম, সহকারী পরিচালক নিগার সুলতানা, সহকারী পরিচালক জাকির হোসেনসহ কয়েকজন কর্মকর্তা। অনুষ্ঠানটি মন্ত্রণালয়ের হলেও মূলত এসব কর্মকর্তারাই সবকিছু আয়োজনের দায়িত্বে ছিলেন। যদিও কাগজপত্রে ছিল নানা উপকমিটি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাউশির উপ-পরিচালক কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘আমি স্টেজে ছিলাম। কেক সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।’ তিনি দাবি করেন, ‘আপ্যায়নের দায়িত্বে ছিলেন মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) আব্দুল মান্নান। তিনি বলতে পারবেন কেকের বিষয়টি। আমি এসময় স্টেজে ছিলাম।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা কামাল হায়দার বিএনপি সরকারের সময় বিএনপির সংসদ সদস্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শামসুল আলম প্রামাণিকের পিএস ছিলেন। বর্তমান মন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে নানা অনুষ্ঠানের কৌশলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলায় পটু এই শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা বিগত মহাপরিচালক ফাহিমা খাতুনের আমলেও ছিলেন মহাক্ষমতাধর।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকার আদলে তৈরি করা কেক আনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন মাউশির পরিচালক আবদুল মান্নান। তিনি বলেন,‘আমি এখানে সম্পূর্ণ নতুন। গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় থেকে পরীক্ষা নিয়ে চরম ব্যস্ত রয়েছি। পদের ধারাবহিকতায় আমাকে আপ্যায়ন কমিটির প্রধান করা হলেও আমি এ সম্পর্কে কিছুই জানি না। জুনিয়র কর্মকর্তারা এসব করেছেন। অনুষ্ঠানের দিনে আমি গিয়ে মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলে পরীক্ষার কাজে চলে এসেছি। আজ (রবিবার) সকালে কেকের বিষয়টি অফিসে এসে শুনেছি।’ কারা এই কেকের পরিকল্পনা ও অর্ডার দিয়েছে তা খোঁজ নিয়ে জানাবেন বলেও তিনি জানান।

Be the first to comment on "শিক্ষামন্ত্রীর অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকার কেক নিয়ে তুলকালাম"

Leave a comment

Your email address will not be published.




four × 4 =